লুকোচুরি শেষে ইডির (ED) হাতে গ্রেফতার তৃণমূল (TMC) বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্য (MANIK BHATTACHARYA)। - গ্রাফিক: সুবর্ণরেখা টিম |
প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে গ্রেফতার আরও রাঘব বোয়াল। মানিক ভট্টাচার্য। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের (West Bengal Primary Education Board) অপসারিত সভাপতি। একইসঙ্গে নদিয়ার পলাশিপাড়ার তৃণমূল (TMC) বিধায়ক। লুকোচুরি শেষ। সিবিআই-এর হাত থেকে গ্রেফতারিতে রক্ষাকবর পেলেও শেষ রক্ষা হল না। অবশেষে মানিককে গ্রেফতার করল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। সোমবার রাত থেকে প্রায় ১৫ ঘণ্টার ম্যারাথন জেরার পর গ্রেফতার মানিক। জোকা ইএসআই হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর আদালতে তোলা হয় মানিককে।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়, কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়, সুবীরেশ ভট্টাচার্যের পর এবার মানিক ভট্টাচার্য। লম্বা হচ্ছে নিয়োগ দুর্নীতিতে গ্রেফতারির তালিকা। তখন থেকেই ওয়াকিবহাল মহল মনে করছিল, মানিকের গ্রেফতারি শুধুই সময়ের অপেক্ষা। সেই অপেক্ষার অবসান হল মঙ্গলবার। নিয়োগ দুর্নীতিতে গ্রেফতারির তালিকায় যোগ হল মানিকের নাম। ইডির দাবি, তদন্তে অসহযোগিতা করেছেন মানিক ভট্টাচার্য। সেই কারণেই গ্রেফতার। এর আগে একাধিকবার মানিককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠিয়েছে সিবিআই। শেষ বার মানিকের হাজিরা নিয়ে বিস্তর নাটক হয়। সিবিআই-এর কাছে হাজিরার নির্দেশ দেন হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু ওই দিন মানিককে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। যাদবপুর থানায় তাঁর বিরুদ্ধে জেনারেল ডায়েরিও করে আসে সিবিআই। না হলে হাইকোর্টের নির্দেশ অবমাননার অভিযোগ উঠত। সেই কারণেই জেনারেল ডায়েরি করে রাখে সিবিআই। পরের দিন মানিকের খোঁজ মেলে দিল্লিতে বঙ্গভবনে। হাইকোর্টের নির্দেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন দাখিল করার জন্য দিল্লিতে ছিলেন বলে হাজিরা দিতে পারেননি, এই মর্মে সিবিআই-কে জানান মানিক। মানিকের বিরুদ্ধে কোনও কঠোর পদক্ষেপ করা যাবে না বলে নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু সেটা সিবিআই-এর মামলায়। রক্ষাকবচ থাকা সত্ত্বেও মানিককে ইডি গ্রেফতার করতে পারে কিনা, তা নিয়ে এবার আইনি লড়াই শুরু হবে। সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারেন মানিকের আইনজীবীরা।
৫৫ জনের মাথাপিছু ৭ লাখ!
কিন্তু মঙ্গলবার মানিকের শুনানিতে ইডির আইনজীবীরা যে তথ্য পেশ করেছেন, তা চোখ কপালে তোলার পক্ষে যথেষ্ট। তাঁরা নথিপত্র পেশ করে আদালতকে জানিয়েছেন, মানিকের অ্যাকাউন্ট থেকে দু’কোটি ৬৪ লক্ষ টাকা উদ্ধার হয়েছে। এছাড়াও মানিকের বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছে একটি সিডি। ওই সিডিতে মিলেছে দু’টি ফোল্ডার। তাতে ৬১ জন চাকরিপ্রার্থীর নাম। তার মধ্যে ৫৫ জনের কাছ থেকে সাত লক্ষ টাকা করে নেওয়া হয়েছে বলে দাবি ইডির। শুধু তাই নয়, মানিকের হোয়াটসঅ্যাপেও মিলেছে চাকরিপ্রার্থীদের তালিকা। একাধিক সন্দেহভাজন মেসেজ উদ্ধার করেছেন ইডির গোয়েন্দারা।
আরও পড়ুন: বছর ঘুরলেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। ভোটে ছাপ ফেলবে এই পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি?
রহস্যময় RK এবং DD
মানিকের মোবাইলের কনটাক্ট লিস্টে RK নামে এক জনের নাম সেভ করা রয়েছে। ওই ব্যক্তিই মানিককে হোয়াটসঅ্যাপে নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ জানিয়েছিলেন। কে এই RK, তা এখনও স্পষ্ট নয়। মানিকের কনটাক্ট লিস্টে আরও এক সন্দেহভাজনের নাম DD। তাঁর সঙ্গেও মানিকের একাধিক হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট উদ্ধার করেছেন গোয়েন্দারা। তবে এই DD-রও পরিচয় পুরোপুরি রহস্যে মোড়া। এই DD কে, তাঁর সঙ্গে মানিকের কী সম্পর্ক, সে সব বিষয় এখনও অন্ধকারে গোয়েন্দারা। কিন্তু এই দুই নাম ঘিরে তৈরি হয়েছে বিস্তর রহস্য। রহস্যময় দুই সংক্ষিপ্ত নামের পুরো নাম কি, তা নিয়ে সব মহলে কৌতূহল তুঙ্গে। এছাড়াও আরও অনেক সন্দেহজনক হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের হদিশ মিলেছে, যাতে দুর্নীতির ইঙ্গিত রয়েছে বলে দাবি ইডির গোয়েন্দাদের। তদন্তে ধীরে ধীরে তা সামনে আসতে পারে।
বিএড কলেজেও কোটি কোটি জালিয়াতি!
ইডির আইনজীবীদের দাবি, পাঁচশোরও বেশি সন্দেহজনক লেনদেনের হদিশ মিলেছে। মানিকের ছেলের একটি সংস্থা রয়েছে। ইডির দাবি, ৫১৪টি বিএড কলেজে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন ও পরিষেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতিটি কলেজ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়েছে। টাকার অঙ্ক যোগ করলে দাঁড়ায় ২ কোটি ৫৭ লক্ষ। বেঙ্গল টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউশনের সঙ্গে ওই কলেজগুলি চুক্তিবদ্ধ হয়। ইডির অভিযোগ, টাকা নেওয়া হলেও ওই কলেজগুলিতে কোনও পরিকাঠামোগত উন্নয়ন বা পরিষেবা দেওয়া হয়নি। আবার বিধানসভা ভোটে মানিক ভট্টাচার্য পলাশিপাড়া কেন্দ্রের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নের সঙ্গে যে এফিডেভিট বা হলফনামা জমা দিয়েছিলেন, তাতে একটি সংস্থার উল্লেখ রয়েছে। ওই সংস্থার নাম টেকনোএড ম্যানেজমেন্ট কনসাল্টেন্সি সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড। হলফনামায় সংস্থার ডিরেক্টর হিসেবে রয়েছে তাঁর স্ত্রীর নাম। এখন এই সংস্থাই মানিকের ছেলের সংস্থা কিনা, তা যাচাই করে দেখছেন ইডির তদন্তকারী অফিসাররা। ওই হলফনামায় স্থাবর অস্থাবর মিলিয়ে মানিক তাঁর সম্পত্তি দেখিয়েছিলেন দু’কোটি ৯৮ লক্ষ ৭০ হাজার ১৮৬ টাকা।
মানিকের কৌঁসুলিদের অরণ্যে রোদন!
ইডির আইনজীবীরা অবশ্য মানিককে ‘ডিফেন্ড’ করতে আস্তিনের অনেক তাসই বের করেছেন। কিন্তু কাজ হয়নি। জামিনের আবেদন করেননি। তাঁদের মূল অভিযোগ ছিল, ইডির গ্রেফতারি বেআইনি। যুক্তি দেন, তাঁদের মক্কেলকে যতবার ডাকা হয়েছে, তিনি হাজিরা দিয়েছেন। ব্যাঙ্কের নথি থেকে যাবতীয় তথ্য ও নথি জমা দিয়েছেন। তার পরেও তদন্তে অসহযোগিতার অভিযোগ কীভাবে। গত কয়েক ঘণ্টায় কী এমন ঘটল যে অসহযোগিতার অভিযোগে গ্রেফতার করতে হল? মানিকের আইনজীবীদের দ্বিতীয় যুক্তি, মানিকের থেকে যে টাকা উদ্ধার হয়েছে, তা সবই চেক, বা ব্যাঙ্কের মাধ্যমে হয়েছে। কোনও নগদ লেনদেনের প্রমাণ দিতে পারেনি ইডি। যাঁরা টাকা দিয়েছেন, তাঁরাও লেনদেনের কথা অস্বীকার করেননি। তাহলে কীভাবে দুর্নীতির অভিযোগ ধোপে টেকে? তৃতীয় যুক্তি, হাইকোর্টের নির্দেশে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত করছে সিবিআই। তাঁরা তদন্ত শেষ করেনি। এখনও চলছে। তার মধ্যে কীভাবে ইডি গ্রেফতার করতে পারে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সে সব ধোপে টেকেনি। মানিককে ১৪ দিনের পুলিসি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।
মেধার ভিত্তিতেই গ্রেফতার মানিক!
মানিক শিবিরে যখন এই টানাপোড়েন, আদালতে লড়াই, তার মধ্যেই উত্ফুল্ল আন্দোলনকারী চাকরিপ্রার্থীরা। চাকরির দাবিতে দীর্ঘদিন পথে বসে আন্দোলন করছেন বহু চাকরিপ্রার্থীরা। মানিকের গ্রেফতারির পরে তাঁদের মধ্যে আনন্দধারা। এই মানিক ভট্টাচার্যই বলেছিলেন, মেধার ভিত্তিতেই নিয়োগ হয়েছে। এদিন মানিকের গ্রেফতারির পর তাঁরা পাল্টা কটাক্ষ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, ‘‘মেধার ভিত্তিতেই মানিক গ্রেফতার হয়েছেন।’’ দুর্গা সেজে অসুর বধের ছবিও দেখা যায় আন্দোলনকারীদের ধর্নামঞ্চে।
আরও পড়ুন: কার্নিভাল লোকারণ্য! ভাঁড়ে মা ভবানি অবস্থায় এই মহা ধুমধাম কি প্রয়োজন ছিল?
মানিক চোর!
মানিক-সহ নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ যে কতটা জমেছে তার প্রমাণ ফের এদিন মিলেছে। পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ইএসআই হাসপাতালে জুতো ছুড়ে মেরেছিলেন এক মহিলা। শোনা গিয়েছিল চোর চোর স্লোগান। অর্পিতাকে জড়িয়ে নানারকম স্লোগানও শোনা গিয়েছিল। এবার মানিককে উদ্দেশ্য করেও চোর চোর স্লোগান দিয়েছেন অনেকে। এদিন আদালতে তোলার সময় মানিকের উদ্দেশে উড়ে আসে এই সব স্লোগান। কয়েকজনের হাতে দেখা যায় পোস্টারও। অথচ তাঁরা কিন্তু নিয়োগ থেকে বঞ্চিত বা চাকরিপ্রার্থী নন। তাঁরা আমজনতা। আদালতে নিজের নিজের কাজে এসেছিলেন। সূতরাং ক্ষোভ-বিক্ষোভ যে আর শুধু চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে সীমিত নেই, এদিনের এই স্লোগান-বিক্ষোভে ফের সেটা বোঝা গেল।
ডক্টর মানিক
কিন্তু কে এই মানিক? আদপে নদিয়ার পলাশিপাড়ার বাসিন্দা। তবে কর্মসূত্রে তিনি দীর্ঘদিন কলকাতার যাদবপুর এলাকার বাসিন্দা। সেখানকারই ভোটার। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে ১৮৭৭ সালে বাণিজ্যে স্নাতকোত্তর। ১৯৯৮ সালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট। পেশায় ছিলেন অধ্যাপক। যোগেশচন্দ্র চৌধুরী আইন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি অবসর নেন। তার পরেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি পদে নিযুক্ত হন। আদালতে মামলা চলাকালীন অবশ্য ওই পদ থেকে মানিককে সরানোর নির্দেশ দেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। সেই মতো ওই পদ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। তবে এখনও তিনি তৃণমূল বিধায়ক। পার্থ চট্টোপাধ্যায় গ্রেফতার এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধারের পর তৃণমূল তাঁকে দল থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে রেখেছে। মানিক ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রেও তেমন কোনও ব্যবস্থা দল নেয় কিনা, সেদিকে নজর থাকবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের। একই সঙ্গে মানিকের আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন কিনা, বা পরবর্তী আইনি লড়াই কোন পথে এগোয় সেদিকেও নজর থাকবে রাজ্যবাসীর।