চাকদহ ও মারিশদার পঞ্চায়েত প্রধানকে (Panchayat Pradhan) অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Abhishek Benerjee) ইস্তফার নির্দেশে কি দলে কোন্দলের আশঙ্কা? অলঙ্করণ: সুবর্ণরেখা টিম |
পূর্ব মেদিনীপুরের (East Midnapore) মারিশদার পর এবার নদিয়ার (Nadia) চাকদহ। ফের পঞ্চায়েত প্রধানকে (Panchayat Pradhan) ইস্তফার নির্দেশ তৃণমূল (TMC) সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Abhishek Banerjee)। মারিশদার নির্দেশের পর মনে হয়েছিল, বিচ্ছিন্ন ঘটনা। নেহাত কাকতালীয়ও হতে পারে। কিন্তু নদিয়ায় পুনরাবৃত্তি হতেই আতঙ্ক ধরেছে তৃণমূল নেতাদের মধ্যে। খোঁজ খবর শুরু হয়ে গিয়েছে অভিষেকের পরবর্তী সভা কবে কোথায়। সেই সভায় আবার কোপ পড়বে কার উপর, তা নিয়েও রাজ্যের শাসক দলের অন্দরে জোর গুঞ্জন।
কাঁথির সভায় যাওয়ার পথে মারিশদার গ্রামে ঢুকে পড়েছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। আবাস যোজনা থেকে আমফানের টাকা না পাওয়া গ্রামবাসীরা ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর কাঁথির সভা থেকেই মারিশদার ওই গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান, উপপ্রধান ও তৃণমূল অঞ্চল সভাপতিকে ইস্তফার নির্দেশ দেন অভিষেক। পরের দিনই তাঁরা ইস্তফা দেন। অন্য দিকে নদিয়ার রানাঘাটের সভা থেকে ইস্তফার নির্দেশ দেন চাকদহের তাতলা ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান পার্থপ্রতীম দে-কে। পার্থপ্রতিম ওই দিনই ইস্তফা দিয়েও দলের বিরুদ্ধে এক রাশ ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন।
পর পর দুই সভায় এমন নির্দেশে তৃণমূলের নীচু স্তুরের কর্মীদের মধ্যে আতঙ্কের চোরাস্রোত বইছে। অনেকেই ভয় পাচ্ছেন, পরের বার সভায় অভিষেকের তোপে বা কোপে পড়বেন কোন নেতা, কোন প্রধান? পরের সভা কোথায়, সেই এলাকায় কার বিরুদ্ধে ক্ষোভ রয়েছে- এই সব বিষয় নিয়ে শুরু হয়েছে গুঞ্জন। কার্যত অভিষেক আতঙ্ক ঢুকে পড়েছে নীচুতলায়। তার উপর আবার অভিষেক বার্তা দিয়েছেন, তিনি নিজে হাল ধরেছেন দলের। আর তিনি কতটা কঠোর, কঠিন তা সবাই জানেন বলেও উল্লেখ করেছেন।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কোথায়?
আপাত সাদাসিধে এই বার্তার নেপথ্যে অবশ্য প্রশ্ন অনেক। দুই প্রধানকে সরানো হয়েছে মানুষের কাজ না করার জন্য বা গ্রামে না যাওয়ার জন্য। অথচ গ্রাম গ্রামে প্রধান, তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ দুর্নীতির। বিরোধীরা বলছেন, পঞ্চায়েতগুলোই আসল দুর্নীতির আঁতুড় ঘর। ঘুঘুর বাসা। সেই দুর্নীতির অভিযোগে এখনও পর্যন্ত একজনকেও সরানো হয়নি বা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অনেকে অবশ্য বলছেন, ঝি-কে মেরে বউকে শেখানোর প্রচেষ্টা এটা। অর্থাত্ এক-দু’জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে গোটা দলকে বার্তা দেওয়া। কিন্তু ক্ষুদ্র স্তরে বার্তা দিয়ে বৃহত্তর পরিসরে তার ফল আদৌ হবে কিনা, সেই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়।
ভোটের আগে কেন? এত দিন ঘুমোচ্ছিলেন?
পঞ্চায়েত ভোট দরজায় কড়া নাড়ছে। ভোট হতে পারে ২০২২-এর মার্চ এপ্রিল বা মে মাসে। বাকি আর মাত্র ৩-৪ মাস। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, শেষ বেলায় এসে এই ঘোষণা কেন? সাড়ে চার বছর ধরে কি দলের নেতারা জানতেন না, নাকি সব জেনেও চুপ করে ছিলেন। প্রায় পুরো ক্ষমতা ভোগ করার পর এখন এই নির্দেশের অর্থই বা কোথায়? বিরোধীদের অভিযোগ, এতদিন পঞ্চায়েত স্তর থেকে দুর্নীতির টাকা উপর মহলে পৌঁছচ্ছিল বলেই কি চুপ ছিলেন। এখন ভোটের মুখে এসে একটা লোকদেখানো গিমিক দিচ্ছেন। ভোট মিটে গেলে আবার যে কে সেই হবে। কেউ কারও কথা শুনবে না।
আরও পড়ুন: উদোর দুর্নীতি বুধোর ঘাড়ে! নেতাদের আবাস তালিকার দায় বিডিওর? মন্ত্রী-বাক্যে ক্ষোভ প্রশাসনে
প্রকাশ্য জনসভায় ঘোষণা কি লোকদেখানো?
প্রশ্ন উঠছে বার্তার আন্তরিকতা নিয়েও। বিরোধীদের অভিযোগমতো গণ হারে না হলেও এমন অভিযোগে অভিযুক্ত যে শুধু এই দু’জন প্রধান নয়, আরও বহু রয়েছে, তা বলাই যায়। তৃণমূলের সংগঠনের যে পরিকাঠামো, পিকের যে নেটওয়ার্ক রয়েছে, তাতে সারা রাজ্যের এই ধরনের সব অভিযোগ এক জায়গায় করতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না। সময় লাগবে মাসখানেক। সেই ভাবে অভিযুক্তদের তালিকা তৈরি করে সাংবাদিক বৈঠক করে ঘোষণা করে অথবা জেলা নেতৃত্বকে পাঠিয়ে দিলেই হয়। তাই পর্যবেক্ষকদের অনকেই প্রশ্ন তুলছেন, এমন প্রকাশ্য সভামঞ্চ থেকে এক দু’জনকে ইস্তফার নির্দেশ কি রাজনৈতিক গিমিক? প্রকৃতই কি শুদ্ধিকরণের বার্তা, নাকি পুরোটাই লোকদেখানো? পাশাপাশি নিজের ওজন বোঝানো এবং দলের কর্তৃত্বের রাশ যে তাঁর হাতে, সেটা বোঝানোও একটা উদ্দেশ্য বটে।
ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা?
জল্পনা আরও রয়েছে। নিয়োগ দুর্নীতিতে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতারি, তাঁর বান্ধবীর বাড়ি থেকে বিপুল টাকা উদ্ধারকাণ্ডে দুর্নীতির তিরে বিদ্ধ রাজ্যের শাসক দল। এ নিয়ে বেজায় অস্বস্তি রয়েছে। তার মধ্যে আবাস যোজনার সমীক্ষায় যে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির অভিযোগ উঠে আসছে, তাতে আরও চাপ বেড়েছে। একশো দিনের কাজ, নির্মল বাংলা প্রকল্পে শৌচালয় তৈরির মতো প্রকল্পেও দুর্নীতির ভুরি ভুরি অভিযোগ। সেই দুর্নীতির ঠগদের বাছতে গেলে কার্যত পঞ্চায়েত উজার হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। সেই কারণেই কি দু’একজনকে হাঁড়িকাঠে চড়িযে ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা? অনেকে এই প্রশ্নও তুলছেন, দুর্নীতির যে বহর, তাতে অশনি সঙ্কেত বুঝে শুদ্ধিকরণ এবং দুর্নীতিমুক্ত করার বার্তা দিতেই কি এমন ইস্তফার নির্দেশ?
ব্যুমেরাং হবে না তো?
কারণ যাই হোক, এই সিদ্ধান্ত ব্যুমেরাং হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ। এই অংশের মতে, পঞ্চায়েত নিয়ে কার্যত দুর্নীতির কাঁড়ি কাঁড়ি অভিযোগ। তার আঁচ অভিষেকও পেয়েছেন রানাঘাটের সভা থেকে। মঞ্চে থেকে যখন প্রশ্ন করেছেন, পঞ্চায়েতের কাজে খুশি কিনা, দর্শকদের মধ্যে থেকে সমস্বরে আওয়াজ এসেছে, না-আ-আ-আ। ফলে পাড়ায় পাড়ায় যে এমন পার্থপ্রতিমই বেশি, তার প্রমাণ হাতে গরম পেয়ে গিয়েছেন তৃণমূল সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক। এই প্রধানরাও তো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো কাজ করেন না। দলের কোনও না কোনও গোষ্ঠীর সদস্য, কোনও না কোনও নেতার ছত্রছায়ায় রয়েছেন। একেবারে নীচু স্তর থেকে শীর্ষ স্তর পর্যন্ত সেই গোষ্ঠীবাজি রয়েছে। ফলে এক জন প্রধানকে সরানোর অর্থ পুরো গোষ্ঠীকে চটিয়ে দেওয়া। ওই পুরো গোষ্ঠী নিষ্ক্রীয় হয়ে যেতে পারেন, পঞ্চায়েত ভোটে। দলে থেকেও বিরোধী দলের হয়ে কাজ করে অন্তর্ঘাত করতে পারেন কিংবা সরাসরি শিবির বদলে ফেলতেও পারেন। সেই আশঙ্কা থেকেই কি ব্যাপক হারে নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে দু’-চার জনকে পদত্যাগের নির্দেশ দিয়ে সামগ্রিকভাবে একটা কড়া বার্তা দেওয়ার প্রচেষ্টা?
আরও পড়ুন: আবাসে দুর্নীতির বাসা! ক্ষীর খাচ্ছেন নেতারা | সমীক্ষায় গিয়ে হুমকি-শাসানিতে আশা-হত কর্মীরা
নির্দলের হয়ে দাঁড়িয়ে গেলে ?
পাশাপাশি এই বরখাস্ত হওয়া নেতা এবং তাঁর গোষ্ঠীর নেতা-কর্মীরা ভোটের সময় নির্দলের টিকিটে প্রার্থী হতে পারেন। এ বছরের গোড়ায় ১০৮ পুরসভার ভোটেও সেই ছবি দেখা গিয়েছে জেলায় জেলায়। তার জন্য বার্তা দিতে হয়েছে খোদ দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কিন্তু তার পরও শেষ পর্যন্ত নির্দলের প্রার্থীই থেকে গিয়েছেন অনেকে। পঞ্চায়েত ভোটেও তেমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আর সেটা হলে ভোট কাটাকাটির অঙ্কে সুবিধা পেয়ে যাবে প্রতিপক্ষ।
খড়গপুরের পুরপ্রধান কিন্তু পদত্যাগ করেননি
আবার দলের নির্দেশ অমান্য করার প্রশ্নও রয়েছে। মারিশদার প্রধান, উপপ্রধান এবং ব্লক সভাপতি অভিষেকের নির্দেশের পরের দিনই ইস্তফা দিয়েছেন। রানাঘাটের ওই প্রধানও অভিষেকের নির্দেশের দিনই পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু ব্যাপক হারে এই ভাবে ইস্তফার নির্দেশ এলে তখনই উঠবে নির্দেশ অমান্য করার প্রশ্ন। সবাই যে অভিষেকের নির্দেশ শিরোধার্য করে পত্রপাঠ ইস্তফা দেবেন, এমনটা নাও হতে পারে। ইতিমধ্যেই তার প্রমাণ মিলেছে খড়গপুরে। খড়গপুরের পুরপ্রধান প্রদীপ সরকারের বিরুদ্ধে দলেরই কাউন্সিলর, নেতারা ক্ষোভ জানিয়ে অভিষেককে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। প্রদীপের ক্ষেত্রে অবশ্য প্রকাশ্য সভায় নয়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ইস্তফার নির্দেশ দিয়েছেন জেলা নেতৃত্বকে। শনিবারের মধ্যে তাঁকে পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিলেন জেলা তৃণমূলের কো-অর্ডিনেটর অজিত মাইতি। কিন্তু সোমবার রাত পর্যন্ত তিনি ইস্তফা দেননি। দলের চাপে শেষ পর্যন্ত ইস্তফা দিতে হলেও তিনি বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীতে নাম লেখাতেই পারেন।
সর্বোপরি ভাবমূর্তির প্রশ্ন। এই এক-দু’জন আসলে সমুদ্রে এক ফোঁটা জলের মতো। কয়েকজনকে সরিয়ে কি গোটা রাজ্যে দলের ভাবমূর্তি ফেরানো যাবে? এমন প্রশ্নও ঘোরাফেরা করছে রাজনৈতিক মহলে। উত্তর পেতে আরও কয়েক মাসের অপেক্ষা।